ডায়াবেটিস এমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যা প্রাথমিকভাবে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু এর প্রভাব কেবল রক্তে শর্করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং সিস্টেমে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে পারে, যার মধ্যে হৃদযন্ত্র ও রক্তনালীর ক্ষতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এটি আরও উদ্বেগের কারণ, কারণ এই অবস্থায় এমন শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয় যা ধীরে ধীরে হৃদযন্ত্র এবং রক্তনালীর কার্যক্ষমতাকে দুর্বল করে। এর ফলে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা CVD-এর ঝুঁকি বাড়ে। এই প্রবন্ধে আমরা ডায়াবেটিস এবং কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের মধ্যে সম্পর্ক, ঝুঁকির কারণ এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ডায়াবেটিস হৃদরোগের জন্য একটি প্রধান ঝুঁকির কারণ। উচ্চ রক্তশর্করা ধীরে ধীরে ধমনির অভ্যন্তরীণ দেয়ালে ক্ষতি করে, যা রক্তপ্রবাহের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করে এবং হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে।
ডায়াবেটিস কীভাবে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ঝুঁকি বাড়ায়?
১. ধমনির ক্ষতি: দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তশর্করা রক্তনালীর দেয়ালে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে দেয়। এটি অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়, যা ধমনিতে চর্বি জমার একটি প্রক্রিয়া।
২. রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি: ডায়াবেটিস রক্তের প্লেটলেটের কার্যক্রমে পরিবর্তন আনতে পারে, যা রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে এবং এর ফলে স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে।
৩. লিপিড প্রোফাইলের পরিবর্তন: ডায়াবেটিসের ফলে “খারাপ” কোলেস্টেরল বা LDL বেড়ে যায় এবং “ভালো” কোলেস্টেরল বা HDL কমে যায়। এর ফলে ধমনির মধ্যে ফ্যাটি প্লাক জমে, যা রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে।
৪. রক্তচাপের বৃদ্ধি: ডায়াবেটিস প্রায়ই উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যা ধমনির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ঝুঁকি বাড়ায়।
ডায়াবেটিসে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের প্রধান কারণ সমূহ
ডায়াবেটিসের সঙ্গে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের গভীর সম্পর্ক থাকার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো নিচে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
১. উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস একসঙ্গে থাকলে এটি কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ রক্তচাপ ধমনির দেয়ালে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা রক্তপ্রবাহের পথ সংকীর্ণ করে এবং হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়ায়।
২. অস্বাভাবিক কোলেস্টেরল (Dyslipidemia): ডায়াবেটিস লিপিড প্রোফাইলকে প্রভাবিত করে। LDL বা “খারাপ” কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং HDL বা “ভালো” কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়। এটি অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায় এবং হৃদরোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।
৩. স্থূলতা (Obesity): স্থূলতা ডায়াবেটিস এবং কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের একটি সাধারণ ঝুঁকির কারণ। অতিরিক্ত ওজন হৃদযন্ত্রের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং রক্তনালীতে চর্বি জমার সম্ভাবনা বাড়ায়।
৪. শারীরিক সক্রিয়তার অভাব (Lack of Physical Activity): শারীরিক সক্রিয়তার অভাব ওজন বৃদ্ধি করে, ইনসুলিন প্রতিরোধ তৈরি করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। এসব কারণ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ঝুঁকি বাড়ায়।
৫. রক্তে উচ্চ রক্তশর্করা (Hyperglycemia): অপরিকল্পিত রক্তশর্করার মাত্রা রক্তনালীর ক্ষতি করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে। এটি ধমনিতে ফ্যাটি প্লাক জমতে সাহায্য করে, যা রক্তপ্রবাহ ব্যাহত করে।
৬. ধূমপান (Smoking): ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ধূমপান বিশেষভাবে ক্ষতিকর। এটি রক্তনালীকে সংকীর্ণ করে এবং রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। ধূমপান ও ডায়াবেটিস একত্রে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ঝুঁকি হ্রাস করার কিছু কার্যকর পদক্ষেপ রয়েছে। এগুলো প্রয়োগ করে জীবনধারার মান উন্নত করা সম্ভব।
১. রক্তে শর্করার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ: ডায়াবেটিসের সঙ্গে জড়িত ঝুঁকি কমানোর প্রথম ধাপ হলো রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। নিয়মিত শর্করার মাত্রা পরীক্ষা এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ডায়েট ও ওষুধ গ্রহণ করুন।
২. সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা: কম চর্বিযুক্ত এবং উচ্চ আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন। ফলমূল, শাকসবজি এবং সম্পূর্ণ শস্য খাদ্য তালিকায় যোগ করুন।
৩. শারীরিক সক্রিয়তা বৃদ্ধি: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শারীরিক অনুশীলন বা হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এটি রক্তচাপ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৪. ধূমপান ত্যাগ করা: ধূমপান পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি। এটি রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা পুনরুদ্ধার করে এবং হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে।
৫. ওজন নিয়ন্ত্রণ: সুস্থ ওজন বজায় রাখার জন্য নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন এবং সুষম খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন।
৬. চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ: ডায়াবেটিস এবং কার্ডিওভাসকুলার ঝুঁকির লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করান।
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল অবস্থা হলেও, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের মতো গুরুতর সমস্যার ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যদি তাদের জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাসে সচেতন পরিবর্তন আনেন, তবে তারা দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন। ডায়াবেটিস এবং কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের সম্পর্ক বোঝা এবং ঝুঁকির কারণ চিহ্নিত করা শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের জন্য নয়, বরং সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন।