পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ (PAD)
Featured Health & Wellness

ডায়াবেটিস এবং পায়ের জটিলতা: পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ (PAD) ও হৃদরোগের ঝুঁকি

পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ (PAD)

রুহুল আমিন, একজন ৪৫ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষক, কয়েক মাস ধরে পায়ে অস্বস্তি অনুভব করছিলেন। হাঁটলে পায়ে ব্যথা হতো, মাঝে মাঝে পা ঠান্ডা হয়ে যেত। তিনি ভেবেছিলেন এটি বয়সজনিত সাধারণ সমস্যা। একদিন তিনি হোঁচট খেয়ে পরে যান আর পায়ে ব্যথা পান। তার পায় কেটে যায় এবং সেরে ওঠার বদলে গুরুতর আকার ধারণ করে। চিকিৎসকের কাছে গেলে জানা যায় রুহুলের ডায়াবেটিস দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ছিল এবং এটি তার রক্তনালী এবং স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর পাশাপাশি, তিনি পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ (PAD)-এ ভুগছিলেন, যা হৃদরোগের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলেছিল।

রুহুলের মতো অনেকেরই এই সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। ডায়াবেটিসের কারণে পায়ে যে জটিলতা দেখা দেয় তা শুধু পায়েই সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি হৃদরোগেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হতে পারে।

 

ডায়াবেটিসজনিত PAD এবং হৃদরোগের মধ্যে সম্পর্ক

ডায়াবেটিসের প্রভাবে শরীরের রক্তনালীগুলো ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতি বিশেষত পায়ের রক্তনালীতে বেশি স্পষ্ট হয়, কারণ পায়ে রক্ত সঞ্চালনের অভাবের কারণে পায়ের টিস্যুতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং পুষ্টি পৌঁছায় না। ফলস্বরূপ, পায়ের টিস্যুগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, যা বিভিন্ন সমস্যা যেমন ক্ষত, ফোস্কা বা এমনকি গ্যাংগ্রিনের মতো গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে।

এই একই রক্তনালীর সমস্যার কারণেই হৃদপিণ্ডেও প্রভাব পড়ে। পায়ের রক্তনালীর সরু হয়ে যাওয়া বা ব্লক হওয়া প্রায়ই হৃদপিণ্ডের রক্তনালীতে একই ধরনের সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। তাই, পায়ে রক্ত সঞ্চালনের ঘাটতি শুধু স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি প্রায়শই হৃদরোগের প্রাথমিক সতর্ক সংকেত হিসেবে কাজ করে।

পায়ে রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা এবং হৃদপিণ্ডের রোগ একই রোগ প্রক্রিয়ার অংশ হওয়ার কারণে, পায়ের যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তনকে অবহেলা করা উচিত নয়। নিয়মিত পায়ের যত্ন এবং সঠিক চিকিৎসা ডায়াবেটিসজনিত পায়ের সমস্যা যেমন প্রতিরোধে সাহায্য করে, তেমনি এটি হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পায়ের সমস্যাগুলো প্রাথমিকভাবে সামান্য মনে হলেও এগুলো দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক হতে পারে। পায়ের সমস্যাগুলো হৃদরোগের সঙ্গে জড়িত হওয়ায়, যে কোনো লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আপনার পায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া মানে আপনার হৃদয়ের সুস্থতার প্রতিও দায়িত্বশীল থাকা।

আপনার পায়ে যে লক্ষণগুলো অবহেলা করবেন না

ডায়াবেটিসজনিত পায়ের সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে দেখা দেয় এবং প্রাথমিক অবস্থায় সেগুলোকে তেমন গুরুতর মনে না হতে পারে। তবে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো আপনার জন্য সতর্ক সংকেত হতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিনঃ

১. পায়ের রং এবং আকার পরিবর্তন

পায়ের স্বাভাবিক রং ফ্যাকাশে, লালচে বা কালচে হয়ে গেলে এটি রক্ত সঞ্চালনের গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। পায়ের আকার অস্বাভাবিক ফুলে যাওয়া বা হ্রাস পাওয়াও একই সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।

২. ঠান্ডা বা গরম অনুভব হওয়া

যদি পায়ে অস্বাভাবিক ঠান্ডা বা গরম অনুভূত হয়, তাহলে এটি রক্ত প্রবাহে বাধার কারণে হতে পারে। পায়ের একটি অংশ ঠান্ডা হয়ে যাওয়া রক্তনালী ব্লকের ইঙ্গিত এবং দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।

৩. ব্যথাহীন ফোস্কা বা ক্ষত

পায়ে ব্যথা অনুভূতি ছাড়াই ফোস্কা বা ক্ষত তৈরি হলে তা অত্যন্ত গুরুতর। এটি সাধারণত স্নায়ুর ক্ষতির কারণে হয়, যা ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। ক্ষতগুলো সময়মতো চিকিৎসা না করলে সেগুলো সংক্রমিত হয়ে গ্যাংগ্রিনে পরিণত হতে পারে।

৪. ক্ষত থেকে দুর্গন্ধ

দীর্ঘদিন ধরে কোনো ক্ষত সেরে না উঠলে এবং সেটি থেকে দুর্গন্ধ পাওয়া গেলে এটি সংক্রমণের লক্ষণ। এই ধরনের সংক্রমণ পায়ে গ্যাংগ্রিনের ঝুঁকি বাড়ায় এবং কখনো কখনো তা অঙ্গহানির কারণ হতে পারে।

৫. পায়ে অবশভাব বা পিন ফোটার মতো অনুভূতি

ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ুর ক্ষতি হলে পায়ে অসাড়তা, অবশভাব বা পিন ফোটার মতো অনুভূতি হতে পারে। এটি অনেক সময় পায়ের ক্ষত চিহ্নিত করতে বাধা দেয় এবং সমস্যা আরও জটিল করে তোলে।

 

প্রতিরোধ এবং যত্ন

ডায়াবেটিসজনিত পায়ের সমস্যা প্রতিরোধে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। নিচের পদক্ষেপগুলো আপনাকে সাহায্য করতে পারে:

১. রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ: নিয়মিত ব্লাড সুগার পরীক্ষা করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

২. পায়ের সঠিক যত্ন: প্রতিদিন পা পরিষ্কার করুন এবং শুকিয়ে নিন। আরামদায়ক এবং সঠিক আকারের জুতা ব্যবহার করুন।

৩. ধূমপান এড়িয়ে চলুন: ধূমপান রক্তনালীগুলোকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

৪. নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম: হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সাহায্য করে।

৫. চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন: পায়ে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান।

ডায়াবেটিসের কারণে পায়ের সমস্যা এবং হৃদরোগের সম্পর্ক গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ। রুহুল আমিনের মতো গল্পগুলো আমাদের সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানায়। পায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া শুধু পায়ের স্বাস্থ্যের জন্য নয়, হৃদপিণ্ডের সুস্থতার জন্যও অপরিহার্য। সতর্কতা এবং নিয়মিত যত্নই আপনাকে সুস্থ এবং হৃদরোগমুক্ত জীবন উপহার দিতে পারে। আপনার শরীরের প্রতি মনোযোগ দিন এবং সুস্থ থাকুন