অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং অন্যান্য জটিলতা বাড়ার আশঙ্কা থাকে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অজান্তেই লবণের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং কিছু সহজ পরিবর্তনের মাধ্যমে লবণের পরিমাণ কমানো সম্ভব। আসুন জেনে নিই কীভাবে আমরা খাবারে লবণের পরিমাণ কমিয়ে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারি।
কেন লবণ কমানো গুরুত্বপূর্ণ?
লবণ আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। এটি শরীরের তরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে, পেশির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে এবং স্নায়ুর সংকেত আদান-প্রদানে সহায়ক। তবে, যখন আমরা বেশি লবণ গ্রহণ করি, তখন এটি শরীরে অতিরিক্ত সোডিয়াম যোগ করে। এই অতিরিক্ত সোডিয়াম শরীরে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তনালীগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণ হয়। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রতিদিন মাত্র ৫ গ্রাম লবণ গ্রহণের পরামর্শ দেয়, যা এক চা-চামচের সমান।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের কারণে শুধু হৃদরোগের ঝুঁকি নয়, কিডনি রোগ, অস্টিওপোরোসিস এবং এমনকি পেটে আলসারের ঝুঁকিও বাড়ে। অতিরিক্ত লবণ কিডনিকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে, যা দীর্ঘমেয়াদে কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। এছাড়া, লবণ ক্যালসিয়ামের নির্গমন বাড়ায়, যা হাড়কে দুর্বল করে এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা শুধু হৃদরোগ নয়, সামগ্রিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও অত্যন্ত জরুরি।
খাবারে লবণ কমানোর সহজ উপায়
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কিছু সহজ পরিবর্তন এনে লবণের পরিমাণ কমানো সম্ভব। নীচে কিছু উপায় আলোচনা করা হলো, যা আপনাকে এই কাজটি সহজ করতে সহায়তা করবে।
১. সবজি ও ফলমূল বেশি করে খান
সবজি ও ফলমূল প্রাকৃতিকভাবে লবণমুক্ত এবং পুষ্টিকর উপাদানে ভরপুর। এগুলোতে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইবার থাকে, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। আপনি যদি প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় সবজি ও ফলমূলের পরিমাণ বাড়ান, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই লবণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারবেন। সবজি ও ফলমূল হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
২. লবণের পরিবর্তে মসলা এবং হার্বস ব্যবহার করুন
অনেকেই খাবারে লবণ দিয়ে স্বাদ বাড়াতে চান। কিন্তু লবণের পরিবর্তে বিভিন্ন প্রাকৃতিক মসলা এবং হার্বস ব্যবহার করলে আপনি খাবারের স্বাদ বাড়াতে পারেন এবং একই সঙ্গে লবণ কমাতে পারবেন। যেমন- ধনে, জিরা, গোলমরিচ, আদা, রসুন, লেবুর রস, এবং বিভিন্ন হার্বস যেমন পার্সলে, বেসিল বা ধনেপাতা ব্যবহার করে খাবারকে আরও সুস্বাদু করা যায়। মসলা ও হার্বস শুধু স্বাদ বাড়ায় না, অনেকগুলোতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহবিরোধী উপাদানও থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
৩. বাড়িতে তৈরি খাবার খান
বাইরের প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং রেস্টুরেন্টের খাবারে সাধারণত লবণের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই যতটা সম্ভব বাড়িতে রান্না করা খাবার খান। বাড়িতে রান্না করার সময় আপনি নিজেই লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এবং স্বাস্থ্যকর উপাদান ব্যবহার করতে পারবেন। এছাড়া, বাড়িতে রান্না করা খাবার সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবারের তুলনায় কম ক্যালরি ও লবণযুক্ত হয়।
৪. খাবার কেনার সময় লেবেল পড়ুন
প্রক্রিয়াজাত খাবার কেনার সময় সবসময় লেবেলের সোডিয়ামের পরিমাণ দেখে নিন। অনেক সময় প্যাকেটজাত খাবারে সোডিয়ামের পরিমাণ লুকানো থাকে, যা আপনি সরাসরি টের পান না। তাই প্যাকেটের গায়ে লেবেল পড়ে সোডিয়ামের পরিমাণ দেখে সেগুলো কিনুন। কম সোডিয়ামযুক্ত খাবার বেছে নেওয়া আপনার হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।
৫. ‘লো সল্ট’ বা ‘নো অ্যাডেড সল্ট’ লেখা পণ্যগুলো বেছে নিন
অনেক কোম্পানি ‘লো সল্ট’ বা ‘নো অ্যাডেড সল্ট’ লেখা পণ্য তৈরি করে, যা সাধারণ পণ্যের তুলনায় লবণের পরিমাণ কম থাকে। এই ধরনের পণ্য বেছে নেওয়া আপনার দৈনন্দিন লবণের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করবে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে দেবে। বিশেষ করে যারা উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগে ভুগছেন, তাদের জন্য এ ধরনের খাবার অত্যন্ত উপকারী।
অতিরিক্ত লবণ আমাদের স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। কিন্তু কিছু সহজ অভ্যাস এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা আমাদের খাদ্যতালিকা থেকে অতিরিক্ত লবণ দূর করতে পারি। বেশি করে সবজি ও ফলমূল খাওয়া, প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা, এবং লবণের পরিবর্তে মসলা ও হার্বস ব্যবহার করা—এসব অভ্যাস আমাদের হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে সহায়ক হবে। তাই আজ থেকেই খাদ্যে লবণের পরিমাণ কমাতে উদ্যোগী হোন এবং সুস্থ জীবনযাপন করুন।