বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে, স্থূলতা ও হৃদরোগ একটি চুপিসাড়া সংক্রান্ত সমস্যা হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জীবনযাত্তনের পরিবর্তন এই দুইয়ের বৃদ্ধির প্রধান কারণ। বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ অনুযায়, ২০% এর বেশি প্রাপ্তবয়স্ক স্থূলতায় আক্রান্ত, যা ১০ বছর আগে মাত্র ১০% ছিল। এই স্থূলতা হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
স্থূলতার বৃদ্ধি:
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, বাংলাদেশে ১৮ বছরের ঊর্ধ্ব ২০% এর বেশি মানুষ অতিরিক্ত ওজনের শিকার। এদের মধ্যে ৫% এরও বেশি স্থূলতায় আক্রান্ত।
- শহর এলাকায় স্থূলতার হার গ্রামীণ এলাকার চেয়ে বেশি। শহরে অস্বাস্থ্যকর খাবার, শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এবং চাপের মতো জীবনধারার কারণে এমনটা হচ্ছে।
- নারীদের মধ্যে স্থূলতার হার পুরুষদের চেয়ে বেশি।
স্থূলতা ও হৃদরোগের মধ্যে সম্পর্ক:
- স্থূলতা হৃদরোগের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। এটি উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস এবং ঘুমের অসুবিধা বিভিন্ন হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
- বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষই স্থূলতায় আক্রান্ত। স্থূলতার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ বা ততোধিক বেড়ে যেতে পারে।
কীভাবে স্থূলতা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়?
- উচ্চ রক্তচাপ: স্থূলতায় রক্তচাপ বেড়ে যায়, যা হৃদপেশীতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং হৃদরোগের প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে।
- উচ্চ কোলেস্টেরল: স্থূলতা ক্ষতিকারক কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ও উপকারী কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়, যা রক্তনালিকা সংকীড়ন ঘটায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
- ডায়াবেটিস: স্থূলতা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে, যা রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের সমস্যা আরও জটিল করে তুলে হৃদরোগের ঝুঁকি আরও বেশি করে।
- স্লিপ অ্যাপনিয়া: স্থূলতায় স্লিপ অ্যাপনিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা ঘুমের সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার একটি অবস্থা। এটি রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয় ও হৃদয়ের ক্ষতি করে।
বাংলাদেশে কেন এই সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ?
- জীবনযাত্তনের পরিবর্তন: দেশে আয়বৃত্তি বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ কমে যাচ্ছে এবং শারীরিক চলাচল কমে যাচ্ছে। ফলে, মানুষের ক্যালোরি গ্রহণ বেশি হচ্ছে এবং ব্যয় কমছে।
- সচেতনতার অভাব: অনেক মানুষই স্থূলতা ও হৃদরোগের মধ্যে সম্পর্ক সম্পর্কে জানেন না। ফলে, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় না।
- স্বাস্থ্যব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা: দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যার কারণে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ ও সঠিক চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
আপনি কি করতে পারেন?
- নিয়মিত শারীরচর্চা করুন: সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট শারীরিক কার্যকলাপ করুন। হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা ইত্যাদি কাজ করতে পারেন।
- স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করুন: ফল, শাকসবজি, শস্যদানা ও lean protein বেশি খান। চর্বিযুক্ত খাবার, মিষ্টি ও ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন।
- আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন: স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। আপনার বিএমআই (Body Mass Index) চেক করুন এবং স্বাস্থ্যকর ওজন রক্ষার চেষ্টা করুন।
- ধূমপান ত্যাগ করুন: ধূমপান হৃদরোগের অন্যতম প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ কারণ। ধূমপান ছেড়ে দিলে আপনার হৃদয়ের স্বাস্থ্য উন্নত হবে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: আপনার ডাক্তার আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি নিরূপণ করতে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করতে পারেন।
বাংলাদেশে এই সমস্যা সমাধানে কী করা দরকার?
- সচেতনতা বৃদ্ধি: স্থূলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি সম্পর্কে সারা দেশে সচেতনতা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল, কমিউনিটি এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে এ বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
- স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রাপ্যতা বাড়ানো: স্বাস্থ্যকর খাবার যেমন ফল, শাকসবজি ও শস্যদানার উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি, স্বাস্থ্যকর খাবার সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
- শারীরিক কার্যকলাপের সুযোগ বাড়ানো: পার্ক, খেলার মাঠ ও ফুটপাতের মতো শারীরিক কার্যকলাপের সুযোগ বাড়ানো দরকার। এছাড়াও, স্কুল ও কর্মক্ষেত্রে শারীরিক কার্যকলাপকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
- স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন: স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন করা দরকার যাতে মানুষ সহজে এবং সাশ্রয়ী মূল্যে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ ও চিকিৎসা পেতে পারে।
বাংলাদেশে স্থূলতা ও হৃদরোগ একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সরকার, স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সচেতন নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব। সকলকে মিলে সুস্থ, সুন্দর ও রোগমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় নেওয়া দরকার।