অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্টের মতো স্পষ্ট লক্ষণ দেখা না গেলে হার্ট সুস্থ আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক সময় হার্টের সমস্যার কোনো দৃশ্যমান উপসর্গ থাকে না। এই অবস্থাকে বলা হয় ‘নীরব হৃদরোগ’ বা ‘সাইলেন্ট হার্ট ডিজিজ’। উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল এবং ডায়াবেটিস—এই তিনটি নীরব ঘাতক গোপনে আমাদের রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। যেহেতু প্রাথমিক পর্যায়ে এদের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না, তাই আমরা অসচেতন থাকি। যখন লক্ষণ প্রকাশ পায়, ততক্ষণে রক্তনালী সংকীর্ণ হয়ে বা ব্লকেজ তৈরি হয়ে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায়, যা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই, নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে এবং এই নীরব ঘাতকদের প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও সুগার (গ্লুকোজ) নিয়মিত পরীক্ষা করা অত্যন্ত অপরিহার্য। এই নিয়মিত পরীক্ষাগুলোই হলো প্রতিরোধের প্রথম ধাপ এবং জীবন বাঁচানোর চাবিকাঠি।
কেন এই তিনটি পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ?
হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য এই তিনটি পরীক্ষার গুরুত্ব এবং এরা কীভাবে ব্লকেজ তৈরি করে তার বিশদ ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো:
- উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): একে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়। রক্তচাপ যখন দীর্ঘ সময় ধরে বেশি থাকে, তখন তা হার্ট এবং রক্তনালীর ভেতরের দেয়ালে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে রক্তনালী শক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা সরাসরি ব্লকেজ (Atherosclerosis) এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত চেকআপ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ নীরবভাবেই হার্টকে দুর্বল করে দিতে পারে।
- উচ্চ কোলেস্টেরল (Hypercholesterolemia): রক্তে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল (LDL) বেড়ে গেলে তা ধমনীর দেওয়ালে চর্বির স্তর বা প্লাক তৈরি করে। এই প্লাক ধীরে ধীরে জমেই হার্টের মূল রক্তনালীগুলোকে সংকীর্ণ করে দেয়, যা হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ। এর মাত্রা পরিমাপের একমাত্র উপায় হলো লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করা।
- ডায়াবেটিস (Diabetes/উচ্চ সুগার): অনিয়ন্ত্রিত রক্তে সুগারের মাত্রা রক্তনালীগুলোর অভ্যন্তরীণ ক্ষতি করে। এটি হার্টের রোগের ঝুঁকি দ্বিগুণ বা তারও বেশি বাড়িয়ে দেয়। ডায়াবেটিস রক্তনালীকে শক্ত করে তোলে এবং উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলজনিত সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়াবেটিসকে হৃদরোগের সমতুল্য ঝুঁকি হিসেবে দেখা উচিত।
আপনার করণীয়: নিয়মিত পরীক্ষার লক্ষ্য
- বয়স অনুযায়ী পরীক্ষা: সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের (৩৫ বছর বয়সের পর) বছরে অন্তত একবার এই তিনটি পরীক্ষা করানো উচিত।
- নিয়ন্ত্রণ রেখা: যদি কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে, তবে চিকিৎসক নির্দেশিত জীবনধারা পরিবর্তন (যেমন: কম লবণ ও চর্বিযুক্ত খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম) এবং ওষুধের মাধ্যমে সেগুলোকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যে রাখা সম্ভব।
- প্রাথমিক হস্তক্ষেপ: নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা গেলে, চিকিৎসার মাধ্যমে তা সম্পূর্ণরূপে নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়।
আপনার স্বাস্থ্য সুরক্ষার
- উপসর্গ: হার্টের সমস্যার কোনো দৃশ্যমান উপসর্গ না থাকলেও আপনি মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকতে পারেন।
- পরিমাপ: নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করুন (সুস্থ থাকলে বছরে একবার)।
- চর্বি: বছরে একবার লিপিড প্রোফাইল (কোলেস্টেরল) পরীক্ষা করিয়ে রক্তে খারাপ চর্বির মাত্রা জানুন।
- শর্করা: নিয়মিত রক্তের সুগার (গ্লুকোজ) পরীক্ষা করে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি নিশ্চিত করুন।
- জীবনধারা: যদি কোনো রিপোর্ট অস্বাভাবিক হয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা পরিবর্তন করুন।
- প্রতিরোধ: প্রাথমিক শনাক্তকরণ হলো হৃদরোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।