Featured Health & Wellness

একটা সিগারেট, হার্টের এক ধাপ পিছিয়ে যাওয়া

একটি সিগারেট হাতে নিয়ে হয়তো আপনি ভাবছেন, এই সামান্য অভ্যাসটি আপনার মনকে শান্ত করছে। কিন্তু সেই একই সময়ে, আপনার হৃদপিণ্ডের উপর কী ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে, তা কি আপনি জানেন? প্রতিটি টান, প্রতিটি ধোঁয়া – আপনার হৃদপিণ্ডকে ঠেলে দিচ্ছে এক অজানা ঝুঁকির দিকে। একটি সিগারেট শুধু ফুসফুসের শত্রু নয়, এটি হৃদপিণ্ডেরও সবচেয়ে বড় শত্রু।

আমাদের সমাজে ধূমপান একটি সাধারণ দৃশ্য হলেও এর দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি সম্পর্কে আমরা অনেকেই উদাসীন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, হৃদরোগজনিত মৃত্যুর প্রধান প্রতিরোধযোগ্য কারণগুলির মধ্যে ধূমপান অন্যতম।

ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব

 

একটি সিগারেটে প্রায় ৭,০০০ এরও বেশি রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যার মধ্যে নিকোটিন এবং কার্বন মনোক্সাইড সবচেয়ে ক্ষতিকর। এই উপাদানগুলি সরাসরি হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালীর উপর আক্রমণ করে।

১. রক্তনালীকে সংকীর্ণ করে (Vasoconstriction): নিকোটিন একটি শক্তিশালী উদ্দীপক, যা রক্তনালীগুলোকে দ্রুত সংকীর্ণ করে তোলে। এর ফলে হৃদপিণ্ডকে রক্ত পাম্প করার জন্য অতিরিক্ত চাপ দিতে হয়, যা উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে। দীর্ঘ সময় ধরে এই অবস্থা চলতে থাকলে রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বহু গুণ বেড়ে যায়।

২. ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল বৃদ্ধি: ধূমপান শরীরের ‘ভালো’ কোলেস্টেরল (HDL) কমিয়ে দেয় এবং ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল (LDL) বাড়ায়। অতিরিক্ত LDL ধমনীর দেওয়ালে প্লাক বা চর্বির স্তর তৈরি করে, যা রক্ত চলাচলের পথকে সরু করে দেয়। এই অবস্থাকে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস বলা হয়, যা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের মূল কারণ।

৩. রক্তে অক্সিজেনের অভাব: সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা কার্বন মনোক্সাইড রক্তে অক্সিজেনের স্থান দখল করে নেয়। এর ফলে শরীরের প্রতিটি কোষে, বিশেষ করে হৃদপিণ্ডের পেশিতে, পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না। অক্সিজেনের অভাবে হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে।

৪. রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বৃদ্ধি: ধূমপান রক্তের প্লেটলেটকে আরও আঠালো করে তোলে। এর ফলে রক্ত জমাট বাঁধার (Blood Clot) সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এই জমাট বাঁধা রক্তনালীতে আটকে গেলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে।

৫. হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি: নিকোটিন হৃদস্পন্দনের গতি বাড়ায়। স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত হৃদস্পন্দন হৃদপিণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে হৃদপিণ্ডকে দুর্বল করে দেয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধূমপান ও হৃদরোগ

 

বাংলাদেশে ধূমপানের হার এখনও উদ্বেগজনক। তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে মধ্যবয়স্কদের মধ্যে এই অভ্যাস ব্যাপক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী:

  • দেশের প্রায় ৪০% পুরুষ কোনো না কোনো ধরনের তামাক সেবন করেন।
  • ধূমপায়ীদের মধ্যে ৮০% এর বেশি মানুষ হৃদরোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন।
  • যারা দিনে অন্তত এক প্যাকেট সিগারেট সেবন করেন, তাদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ

সচেতনতার জন্য করণীয়

 

ধূমপান ত্যাগ করা হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। ধূমপান ছাড়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শরীরের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় এবং এক বছরের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।

 

স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলুন:

 

  • ধূমপান ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিন: দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং ইচ্ছাশক্তি হলো প্রথম পদক্ষেপ।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: ধূমপান ছাড়তে চিকিৎসকের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। তারা বিভিন্ন ধরনের থেরাপি বা ঔষধের মাধ্যমে সাহায্য করতে পারেন।
  • বিকল্প খুঁজুন: সিগারেট খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হলে এর পরিবর্তে চুইংগাম, লজেন্স বা স্বাস্থ্যকর স্ন্যাক্স খেতে পারেন।
  • সক্রিয় থাকুন: নিয়মিত ৩০ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম করুন। এটি শরীরকে সতেজ রাখে এবং ধূমপানের আকাঙ্ক্ষা কমাতে সাহায্য করে।
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ: তাজা ফল, শাকসবজি এবং কম চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন।
  • পরিবার ও বন্ধুর সমর্থন: ধূমপান ছাড়ার এই যাত্রায় পরিবার ও বন্ধুদের সমর্থন খুবই জরুরি।

একটি সিগারেট কেবল একটি নেশা নয়, এটি আপনার হৃদয়ের উপর এক ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার একটি সংকেত। ধূমপানের প্রতিটি টানে আপনি আপনার সুস্থ জীবনের প্রতিটি স্পন্দনকে ঝুঁকিতে ফেলছেন। মনে রাখবেন, ধূমপান ত্যাগ করা কেবল আপনার জন্য নয়, বরং আপনার পরিবারের সদস্যদের জন্যও একটি সুস্থ ও নিরাপদ ভবিষ্যতের অঙ্গীকার। আজই এই ক্ষতিকর অভ্যাসটি ত্যাগ করুন এবং আপনার হৃদপিণ্ডকে একটি সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের পথে ফিরিয়ে আনুন।

 

 

 

 

তথ্যসূত্র:

 

  • World Health Organization – Tobacco and heart disease
  • Centers for Disease Control and Prevention (CDC) – Smoking & Heart Disease
  • National Heart, Lung, and Blood Institute (NHLBI) – Smoking and Your Heart